Ticker

6/recent/ticker-posts

বৃহস্পতি গ্রহে জীবের অস্তিত্যের সম্ভাব্যতা কতটুকু



বৃহস্পতি গ্রহের ধারনাঃ


বৃহস্পতি গ্রহ সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে পঞ্চম এবং আকার আয়তনের দিক দিয়ে সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ। বৃহস্পতি ব্যতিত সৌর জগতের বাকি সবগুলো গ্রহের ভরকে একত্র করলে বৃহস্পতির ভর তা থেকে আড়াই গুণ বেশি হবে। বৃহস্পতিসহ আরও তিনটি গ্রহ অর্থাৎ শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনকে একসাথে গ্যাস দানব বলা হয়। এই চারটির অপর জনপ্রিয় নাম হচ্ছে জোভিয়ান গ্রহ। জোভিয়ান শব্দটি জুপিটার শব্দের বিশেষণ রুপ। জুপিটারের গ্রিক প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয় জিউস। এই জিউস থেকেই জেনো- মূলটি উৎপত্তি লাভ করেছে। এই মূল দ্বারা বেশ কিছু জুপিটার তথা বৃহস্পতি গ্রহ সংশ্লিষ্ট শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন: জেনোগ্রাফিক। পৃথিবী থেকে দেখলে বৃহস্পতির আপাত মান পাওয়া যায় ২.৮। এটি পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান তৃতীয় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। কেবল চাঁদ এবং শুক্র গ্রহের উজ্জ্বলতা এর থেকে বেশি। অবশ্য কক্ষপথের কিছু বিন্দুতে মঙ্গল গ্রহের উজ্জ্বলতা বৃহস্পতির চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। সুপ্রাচীনকাল থেকেই গ্রহটি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষীদের কাছে পরিচিত ছিল। বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রচুর পৌরাণিক কাহিনী এবং ধর্মীয় বিশ্বাসও আবর্তিত হয়েছে বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে। রোমানরা গ্রহটির নাম রেখেছিল পৌরাণিক চরিত্র জুপিটারের নামে। জুপিটার রোমান পুরাণের প্রধান দেবতা। এই নামটি প্রাক-ইন্দো-ইউরোপীয় ভোকেটিভ কাঠামো থেকে এসেছে যার অর্থ ছিল আকাশের পিতা।

বৃহস্পতি গ্রহের প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে হাইড্রোজেন এবং সামান্য পরিমাণ হিলিয়াম। এতে অপেক্ষাকৃত ভারী মৌলসমূহ দ্বারা গঠিত একটি কেন্দ্রও থাকতে পারে। খুব দ্রুত ঘূর্ণনের কারণে এর আকৃতি হয়েছে কমলাকৃতির গোলকের মত, বিষুবের নিকটে ক্ষুদ্র কিন্তু চোখে পড়ার মত উল্লেখযোগ্য একটি স্ফীতি অংশ রয়েছে। বাইরের বায়ুমণ্ডল বিভিন্ন অক্ষাংশে বিভিন্ন ব্যান্ডে বিভক্ত যেগুলো বেশ সহজেই চোখে পড়ে। এ কারণে একটি ব্যান্ডের সাথে অন্য আরেকটি ব্যান্ডের সংযোগস্থলে ঝড়-ঝঞ্ঝাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে। এ ধরনের পরিবেশের একটি অন্যতম ফলাফল হচ্ছে মহা লাল বিন্দু (great red spot)। এটি মূলত একটি অতি শক্তিশালী ঝড় যা সপ্তদশ শতাব্দী থেকে একটানা বয়ে চলেছে বলে ধারণা করা হয়। গ্রহটিকে ঘিরে এবটি দুর্বল গ্রহীয় বলয় এবং শক্তিশালী ম্যাগনেটোস্ফিয়ার রয়েছে। সর্বশেষ তথ্য মতে, বৃহস্পতির রয়েছে ৭৯টি উপগ্রহ, যাদের মধ্যে ৪টি উপগ্রহ বৃহৎ আকৃতির। এই চারটিকে গ্যালিলীয় উপগ্রহ বলা হয়। কারণ ১৬১০ সালে গ্যালিলিও প্রথম এই চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন। সর্ববৃহৎ উপগ্রহ গ্যানিমেডের আকৃতি বুধ গ্রহের চেয়েও বেশি। বিভিন্ন সময় বৃহস্পতি গবেষণার উদ্দেশ্যে মহাশূন্য অভিযান প্রেরিত হয়েছে। পাইওনিয়ার এবং ভয়েজার প্রোগ্রামের মহাশূন্যযানসমূহ এর পাশ দিয়ে উড়ে গেছে। এর পরে গ্যালিলিও অরবিটার প্রেরিত হয়েছে। সবশেষে প্রেরিত অভিযানের নাম নিউ হরাইজন্‌স যা মূলত প্লুটোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এটি বৃহস্পতির নিকট দিয়ে গেছে। পরবর্তীতে ইউরোপা উপগ্রহের উদ্দেশ্যে অভিযান পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।


গঠন

বৃহস্পতি চারটি বৃহৎ গ্যাসীয় দানবের একটি, অর্থাৎ এটি প্রাথমিকভাবে কঠিন পদার্থ দ্বারা গঠিত নয়। সৌর জগতের বৃহত্তম এই গ্রহটির ব্যাস বিষুবরেখা বরাবর ১৪২,৯৮৪ কিমি। এর ঘনত্ব ১.৩২৬ গ্রাম/সেমি³ যা গ্যাসীয় দানবগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অবশ্য পার্থিব যেকোন গ্রহ থেকে এর ঘনত্ব কম। গ্যাসীয় দানবগুলোর মধ্যে নেপচুনের ঘনত্ব সর্বোচ্চ।


গাঠনিক উপাদান

বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের উর্দ্ধাংশের গাঠনিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে পরমাণু সংখ্যার দিক দিয়ে ৯৩% হাইড্রোজেন ও ৭% হিলিয়াম। আর গ্যাস অণুসমূহের ভগ্নাংশের দিক দিয়ে ৮৬% হাইড্রোজেন ও ১৩% হিলিয়াম। ডানের ছকে পরিমণগুলো দেয়া আছে। হিলিয়াম পরমাণুর ভর যেহেতু হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের চারগুণ সেহেতু বিভিন্ন পরমাণুর ভরের অনুপাত বিবেচনায় আনা হলে শতকরা পরিমাণটি পরিবর্তিত হয়। সে হিসেবে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের গাঠনিক উপাদানের অনুপাতটি দাড়ায় ৭৫% হাইড্রোজেন, ২৪% হিলিয়াম এবং বাকি ১% অন্যান্য মৌল। অন্যদিকে অভ্যন্তরভাগ খানিকটা ঘন। এ অংশে রয়েছে ৭১% হাইড্রোজেন, ২৪% হিলিয়াম এবং ৫% অন্যান্য মৌল। এছাড়া বায়ুমণ্ডল গঠনকারী অন্যান্য মৌলের মধ্যে রয়েছে



বৃহস্পতি প্রহের উপগ্রহ সমূহঃ


বৃহস্পতি গ্রহের ৭৯টি প্রাকৃতিক উপগ্রহ রয়েছে বলে জানা যায়।অর্থাৎ, শনির বলয়স্থিত উপগ্রহিকাগুলিকে বাদ দিলে সৌরজগতের গ্রহগুলির মধ্যে বৃহস্পতিরই সর্বাধিক সংখ্যক যুক্তিসঙ্গতভাবে স্থায়ী কক্ষপথযুক্ত জ্ঞাত প্রাকৃতিক উপগ্রহ রয়েছে। এগুলির মধ্যে বৃহত্তম চারটি উপগ্রহ গ্যালিলিয়ান চাঁদ নামে পরিচিত। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলি ও সাইমন মরিয়াস পৃথক পৃথক ভাবে এগুলি আবিষ্কার করেন। এই উপগ্রহগুলিই আবিষ্কৃত প্রথম মহাজাগতিক বস্তু, যেগুলি পৃথিবী বা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে না। ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে অনেকগুলি ক্ষুদ্রতর বার্হস্পত্য চাঁদ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির নামকরণ করা হয়েছে রোমান দেবতা জুপিটার অথবা তার গ্রিক রূপ জিউসের প্রেমিক-প্রেমিকা বা কন্যাদের নামানুসারে। বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত বৃহত্তম ও সর্বাপেক্ষা অধিক ভরযুক্ত বস্তুগুলি হল এই গ্যালিলিয়ান চাঁদ চারটি। অন্যান্য জ্ঞাত ৭৫টি চাঁদ ও বলয়গুলির একত্রিত ভর এই গ্রহটিকে প্রদক্ষিণরত বস্তুগুলির সামগ্রিক ভরের ০.০০৩% মাত্র।


বৃহস্পতির প্রাকৃতিক উপগ্রহগুলির মধ্যে আটটি নিয়মিত প্রাকৃতিক উপগ্রহ। এগুলি অনুগামী গতিতে প্রায় বৃত্তাকার কক্ষে বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করছে। এই উপগ্রহগুলির কক্ষপথ বৃহস্পতির নিরক্ষীয় তলের সঙ্গে নতি খুব বেশি নয়। গ্রহীয় ভরের কারণে গ্যালিলিয়ান চাঁদগুলির আকার প্রায় গোলকাকার। তাই এগুলি যদি সরাসরি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করত, তাহলে এগুলিকে অন্ততপক্ষে বামন গ্রহ হিসাবে বিবেচনা করা হত। অপর চারটি নিয়মিত উপগ্রহ তুলনামূলকভাবে আকারে অনেক ছোটো এবং বৃহস্পতির অপেক্ষাকৃত নিকটে অবস্থিত। এগুলিই সেই ধূলির উৎস যা দ্বারা বৃহস্পতির বলয়গুলি গঠিত হয়েছে। বৃহস্পতির অবশিষ্ট উপগ্রহগুলি অনিয়মিত। এগুলির অনুগামী ও বিপরীতগামী কক্ষপথগুলি বৃহস্পতির থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে অবস্থিত এবং বৃহস্পতির নিরক্ষীয় তলের সঙ্গে এগুলির নতি ও উৎকেন্দ্রিকতা অনেক বেশি। সম্ভবত বৃহস্পতির আকর্ষণে সৌর কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে এগুলি বৃহস্পতির উপগ্রহে পরিণত হয়েছে। এই অনিয়মিত উপগ্রহগুলির মধ্যে সাতাশটির এখনও আনুষ্ঠানিক নামকরণ করা হয়নি।


বৃহস্পতি গ্রহের উদ্ভব ও পরিবর্তনঃ

বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, বৃহস্পতির নিয়মিত উপগ্রহগুলির উদ্ভব ঘটেছিল একটি গ্রহপ্রদক্ষিণকারী চাকতি থেকে। প্রাক্‌গ্রহ চাকতির অনুরূপ এই চাকতিটি ছিল ঘনায়মান গ্যাস ও কঠিন বর্জ্যের একটি বলয়। সম্ভবত বৃহস্পতির ইতিহাসের আদি পর্বে একাধিক গ্যালিলীয়-ভরযুক্ত উপগ্রহের অবশেষ ছিল এই গ্যাস ও বর্জ্যের উৎস।


সিম্যুলেশনের বিষয়টি দেখে অনুমান করা হয় যে, চাকতিটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে আপেক্ষিকভাবে উচ্চ ভরযুক্ত ছিল। কালক্রমে বৃহস্পতির ভরের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (একাধিক ক্ষেত্রে দশ-শতাংশ) পাশ দিয়ে যাওয়া সৌর নীহারিকা থেকে বন্দি হয়ে পড়ে। যদিও বৃহস্পতির প্রাক্‌-চাকতি ভরের মাত্র ২ শতাংশই বিদ্যমান উপগ্রহগুলিকে ব্যাখ্যা করার পক্ষে যথেষ্ট। বৃহস্পতির আদি ইতিহাসে সম্ভবত একাধিক প্রজন্মের গ্যালিলীয়-ভরযুক্ত উপগ্রহের অস্তিত্ব ছিল। চাকতি থেকে টেনে নেওয়ার জন্য প্রত্যেক প্রজন্মের উপগ্রহগুলি হয়তো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বৃহস্পতির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। সেই সঙ্গে সৌর নীহারিকা থেকে বন্দি করা নতুন বর্জ্য থেকে নতুন উপগ্রহের সৃষ্টি হয়। বর্তমান (সম্ভবত পঞ্চম) প্রজন্মের উপগ্রহগুলি সৃষ্টির সময় চাকতিটি এতটাই ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল যে উপগ্রহগুলির কক্ষপথে সেটি আর বড়ো অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারেনি।বর্তমান গ্যালিলীয় উপগ্রহগুলি তখনও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল, বৃহস্পতিতে বিলীন হওয়ার পথে ছিল এবং পরস্পরের মধ্যে একটি কাক্ষিক অনুরণনের দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। এই কাক্ষিক অনুরণন আইয়ো, ইউরোপা ও গ্যানিমিডের ক্ষেত্রে এখনও বিদ্যমান। গ্যানিমিডের অধিকতর ভরের অর্থ এটি ইউরোপা ও আইয়ো অপেক্ষা দ্রুত হারে বৃহস্পতিতে বিলীন হচ্ছে।


বিজ্ঞানীরা আরও মনে করেন যে, বহিঃস্থ অনিয়মিত উপগ্রহগুলির উৎস হল বৃহস্পতির অভিকর্ষজ টানে আটকে পড়া গ্রহাণুগুলি। প্রাক্‌চান্দ্র চাকতিটি তখনও এতটাই বড়ো ছিল যে সেগুলির ভরবেগের অনেকটাই আত্মীভূত করে এবং সেইভাবেই এগুলি বৃহস্পতির কক্ষপথে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। মনে করা হয় যে, অনেকগুলি উপগ্রহ এই অভিকর্ষজ টানে আবদ্ধ হওয়া প্রক্রিয়ায় যান্ত্রিক চাপে অথবা পড়ে অন্যান্য ক্ষুদ্রাকার বস্তুর সঙ্গে সংঘাতের ফলে ভেঙে পড়ে। আজ আমরা যে উপগ্রহগুলিকে দেখি, সেগুলি এরই ফলে সৃষ্ট।


grid-small

Post a Comment

0 Comments